রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১১ পূর্বাহ্ন

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি… মোরা একটি মুখের হাসির…

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি… মোরা একটি মুখের হাসির…

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই; এক কাকডাকা প্রভাতে- ভারতের ‘মেলাঘর’ নামক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে- কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে, দুই সারিতে ৩৮ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল পাহাড় থেকে সমতলের দিকে নেমে আসছে। সকলে সমবেত স্বরে গাইছে- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি…’। ২নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দারের নির্দেশে ওদের গন্তব্যস্থল ছিল রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা। উদ্দেশ্য হলো আকস্মিকভাবে, আতর্কিতে গেরিলা হামলার মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাতে- পাক হানাদারদের নাস্তানাবুদ করা। শুধু তাই নয়; বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজ-কালভার্ট, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এক্সক্লুসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। মেজর খালেদ মোশারফের থিউরিটি ছিল- এভাবে পাক হানাদারদের অতিদ্রুত আতংকিত করে তোলা এবং ওদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। আর এ প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক গেরিলা দলটি যখন দেশের ভিতরে প্রবেশ করল তখন ওদেরকে দেখে স্থানীয় জনগণের কাছে মনে হয়েছিল ‘ওরা যেন- ফিদেলক্যাষ্টো কিংবা চে’গুয়েভারার অনুগত গেরিলা যোদ্ধাদল। যুদ্ধই যাদের জীবন। তারা বিশ্বাস করে, মৃত্যুর সংগ্রামের কোন সীমানা নেই।
এবার একটু পিছনে ফিরে তাকাই, দলটিতে যারা রয়েছে তারা অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অভিজাত পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কেউবা ছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়, কেউবা ছিল সংস্কৃতিমনা রোমিও। যেমন- শাহাদাৎ চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাংবাদিক), রাইসুল ইসলাম আসাদ (পরবর্তীকালের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা) নাসির উদ্দিন ইউসুফ (পরবর্তীকালের বিখ্যাত নাট্যকার), শহীদ জুয়েল (সেই সময়ের জাতীয় দলের বিখ্যাত ক্রিকেটার), শহীদ রুমী (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান), শহীদ বদি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরএন.এস.এফ নেতা ও ত্রাস), সাদেক হোসেন খোকা (পরবর্তীকালে ঢাকার মেয়র), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী), কাজী কামাল (সেই সময়ের জাতীয় ভলিবল দলের ক্যাপটেন), ঢাকার সবচেয়ে ধনাঢ্যব্যক্তি ইউনুস আলীর একমাত্র সন্তান শহীদ আজাদ ও হাবিবুল বাশার বীর বিক্রম প্রমুখ। ’৭১ এর পূর্বে কেউ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কেউ কেউ খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। তখন আসাদ, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ, রুমী, আজাদরা সুন্দরী রমনীদের দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বারান্দার বেলকুনিতে বসে আবৃত্তি করত-
ওপেনটি বায়োস্কোপ, নাইন টেন তেইশকোপ, সুলতানা বিবিয়ানা, সাহেব বিবির বৈঠকখানা, মেম বলেছেন যেতে, পান সুপারি খেতে, আমার নাম রেণুবালা, গলায় আমার মুক্তার মালা…।
তবে তাদের সেই সোনালী বিকেলগুলো হারিয়ে গেল সময়ের দাবীতে। সবারই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তখন একই সত্ত্বায় আবদ্ধ। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে; হানাদারদেরকে বাঙলার মাটি থেকে তাড়াতে হবে। শহীদ রুমি ইন্টার মিডিয়েটে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভাল রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে আমেরিকার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও চান্স পেয়েছে। আগামী সেমিষ্টারে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। দেশে যুদ্ধ শুরু না হলে, এতদিনে চলে যেত প্রবাসে। কাজী কামাল আর আজাদ ছিল ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সহপাঠী। ইংরেজী বলা ও অনুবাদ করার ক্ষেত্রে আজাদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। অপরদুই গেরিলা বদি ও বাদল ছিল সহপাঠী। উভয়েই ফৌজদারহাট ক্যাডেট থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশুনা করত। তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিস্তর ফারাক ছিল। কিশোরগঞ্জের ছেলে বদিউল আলম বদি এইচ.এস.সি তে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করে; ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মুনায়েম খান সমর্থিত এন.এস.এফ নেতা ও ত্রাস বনে যায়। আর শহীদুল্লাহ খান বাদল আরেক মেধাবী ছাত্র ছিলেন, সে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা দুটোতেই সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। অন্যদিকে সেই সময়ের আরেক গেরিলা যোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদের অভিনয় প্রতিভা- বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে বেইলী রোডের ঢাকা থিয়েটার পর্যন্ত দীপ্তিময় হয়ে উঠেছিল। নাট্যতত্ত্বের ছাত্র নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু মঞ্চ নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে সবেমাত্র বিখ্যাত হতে শুরু করেছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হলো যুদ্ধ- যুদ্ধ খেলা। মুক্তি অর্জনের তাগিদ। ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাক হানাদারদের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড দেখে এসব তরুনদের রক্তে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠল।
বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফ ঢাকার ছাত্রদের ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য গোপন বার্তা পাঠালেন। গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার পাক বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার পরিকল্পনা নেন। প্রথম টিমে বাদল, মায়া, কাজী কামাল, শাহাদাৎ চৌধুরী প্রমুখদের দলটি মেলাঘরে পৌঁছল। আবার মাস খানেকের মধ্যেই রুমি, আজাদ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ, আসাদ, খোকা প্রমুখ ট্রেনিং নিতেগেল। এবার পূর্বের কথায় ফিরে আসি। পুরো টিম নেমে গেল গেরিলা অপারেশনে। তারা আক্রমণ করল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, আক্রমণ করল চীনা দূতাবাসে- উড়িয়ে দিল সীদ্ধীরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তাদের কয়েকটি দুর্ধর্ষ ও সফল অপারেশনের পর আতংকিত হয়ে গেল, রাজাকার-আলবদরেরা। আর সর্বাধিক প্রচারিত গণমাধ্যম বিবিসি থেকে প্রচারিত খবরে এদেরকে নাম দেওয়া হয়েছিল স্ট্রীট ফাইটার বা মহাসড়কের যোদ্ধা। অত্যন্ত দু:খ ও পরিতাপের বিষয় আগষ্ট  মাসের ২৯-৩০ তারিখে আজাদের বাসা থেকে বেশ কয়েকজন গেরিলা পাক বাহিনীর হাতে ধৃত ও শহীদ হন। এদের মধ্যে আজাদ, বদি, জুয়েল, রুমি প্রমুখরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের লাল সবুজের রক্তিম পতাকার জন্ম দিল।

শাফায়েত জামিল রাজীব
প্রধান সম্পাদক, একুশে টাইমস্

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana