বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই, ভারতের ‘মেলাঘর’ নামক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে; কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে, দুই সারিতে ৩৮ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল পাহাড় থেকে সমতলের দিকে নেমে আসছে। সকলে সমবেত স্বরে গাইছে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি…’। ২নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশারফ ও মেজর হায়দারের নির্দেশে ওদের গন্তব্যস্থল হলো রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা। উদ্দেশ্য হলো আকস্মিকভাবে, আতর্কিতে গেরিলা হামলার মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাতে পাক হানাদারদের নাস্তানাবুদ করা। শুধু তাই নয়; বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ ব্রীজ-কালভার্ট, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এক্সক্লুসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। মেজর খালেদ মোশারফের থিউরিটি ছিল- এভাবে পাকহানাদারদের অতিদ্রুত আতংকিত করে তোলা এবং ওদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। আর এ প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক গেরিলা দলটি যখন দেশের ভিতরে প্রবেশ করল তখন ওদেরকে দেখে স্থানীয় জনগণ এর কাছে মনে হয়েছিল ‘ওরা যেন- ফিদেলক্যাষ্টো কিংবা চে’গুয়েভারার অনুগত গেরিলা যোদ্ধাদল। যুদ্ধই যাদের জীবন। তারা আত্মবিশ্বাসী করে মৃত্যুর সংগ্রামের কোন সীমানা নেই।
এবার একটু পিছনে ফিরে তাকাই দলটিতে যারা রয়েছে তারা অধিকাংশই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ও অভিজাত পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কেউবা ছিল জাতীয় দলের খেলোয়াড়, কেউবা ছিল সংস্কৃতিকমনা রোমিও। যেমন- শাহাদাৎ চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাংবাদিক), রাইসুল ইসলাম আসাদ (পরবর্তীকালের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা) নাসির উদ্দিন ইউসুফ (পরবর্তীকালের বিখ্যাত নাট্যকার), শহীদ জুয়েল (সেই সময়ের জাতীয় দলের বিখ্যাত ক্রিকেটার), শহীদ রুমী (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান), শহীদ বদি (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এন.এস.এফ নেতা ও ত্রাস), সাদেক হোসেন খোকা (পরবর্তীকালে ঢাকার ঢাকার মেয়র), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী), কাজী কামাল (সেই সময়ের জাতীয় দলের বিখ্যাত ভলিবল দলের ক্যাপটেন), ঢাকা সবচেয়ে ধনাঢ্যব্যক্তি ইউনুস আলীর একমাত্র সন্তান শহীদ আজাদ প্রমুখ। ’৭১ এর পূর্বে কেউ ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কেউ কেউ খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। তখন আসাদ, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ, রুমী, আজাদরা সুন্দরী রমনীদের দেখে কলা ভবনের বারিন্দার বেলকুনিতে বসে আবৃত করত-
ওপেনটি বায়োস্কোপ, নাইন টেন তেইশকোপ, সুলতানা বিবিয়ানা, সাহেব বাবুর বৈঠকখানা, মেম বলেছেন যেতে..পান সুপারি খেতে, আমার নাম রেণুবালা, গলায় আমার মুক্তার মালা।
তবে তাদের সেই সোনালী বিকেলগুলো হারিয়ে গেল সময়ের দাবীতে সবারই উদ্যেশ্য ও লক্ষ্য তখন এই সত্ত্বায় আবদ্ধ। দেশকে শুত্রুমুক্ত করতে হবে; হানাদারদেরকে বাঙলার মাটি থেকে তাড়াতে হবে। শহীদ রুমি ইন্টার মিডিয়েটে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভাল রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে আমেরিকার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও চান্স পেয়েছে। আগামী সেমিষ্টারে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। দেশে যুদ্ধ শুরু না হলে এতদিনে চলে যেত প্রবাসে উচ্চ শিক্ষার্থে উদ্দেশে। কাজী কামাল ছিল আর আজাদ ছিল ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সহপাঠী। ইংরেজী বলা ও অনুবাদ করার ক্ষেত্রে আজাদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। অপরদুই গেরিলা বদি ও বাদল ছিল সহপাঠী। উভয়েই ফেজদারহাট ক্যাডেট থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি পাশ করে অর্থনীতি বিভাগে পড়াশুনা করত। তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বিস্তর ফারাক ছিল। কিশোরগঞ্জের ছেলে বদিউল আলম বদি এইচ.এস.সি তে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জনে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মুনায়েম খান সমর্থিত এন.এস.এফ নেতা ও ত্রাস বনে যায়। আর শহীদুল্লাহ খান বাদল আরেক মেধাবী ছাত্র ছিল; সে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষা দুটোতেই সম্মিলিত মেধা তালিকা প্রথম স্থান অর্জন করে। অন্যদিকে সেই সময়ের আরেক গেরিলা যোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদের অভিনয় প্রতিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে বেইলী রোডের ঢাকা থিয়েটার পর্যন্ত দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। নাট্যতত্ত্বের ছাত্র নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু মঞ্চ নাটকের স্কিপ লিখে সবেমাত্র বিখ্যাত হতে শুরু করেছিলেন। এরই মধ্যে যুদ্ধ। মুক্তি অর্জনের তাগিদ শুরু হয়ে গেল। ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাক হানাদারদের বর্বর চিত্র হত্যাকান্ড দেখে এসব তরুনদের রক্তে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠল।
বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশারফ ঢাকার ছাত্রদের ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য গোপন বার্তা পাঠালেন। গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাতে পাক বাহিনী পযুদস্ত করা চিন্তা নিয়ে কাজটি করলেন। প্রথম টিমে বাদল, মায়া, কাজী কামাল, শাহাদাৎ চৌধুরী প্রমুখদের দলটি মেলাঘরে পৌঁছল। আবার মাস খানেক মধ্যে বদি, রুমি, আজাদ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ আসাদ, খোকা প্রমুখ ট্রেনিং নিতেগেল। আবার পূর্বের কথায় ফিরে আসি। পুরো টিম নেমে গেল গেরিলা অপারেশনে। তাদের কয়েকটি দুর্ধর্ষ ও সফল অপারেশনের পর আতংকিত হয়ে গেল রাজাকার আলবদরেরা। আর সর্বাধিক প্রচারিত গণমাধ্যম বিবিসি থেকে প্রচারিত খবরে এদেরকে নাম দেওয়া হয়েছিল স্ট্রীট ফাইটার বা মহাসড়কের যোদ্ধা।
শাফায়েত জামিল রাজীব
প্রধান সম্পাদক, একুশে টাইমস্