শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন

জেল হত্যা দিবস: জাতির কলঙ্ক

জেল হত্যা দিবস: জাতির কলঙ্ক

’৭৫-এর ৩ নভেম্বর হলো বাঙালির জাতির জন্য একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিশারী, চার জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অর্থমন্ত্রী (’৭২-’৭৪), পচাত্তরে বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আওয়ামীলীগের সভাপতি আবুল হায়াত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে কারাগারের অন্ধকার সেলে বিনা বিচারে গুলি ও বেনেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায়; খন্দকার মোশতাক ও বঙ্গবন্ধুর খুনী মেজর চক্রের নীলনকশায় প্রাণ হারালো চার দেশপ্রেমিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার আমিনুল হক ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, ঘাতকের দল জেল খানায় পৌঁছাতেই অফিসের টেলিফোনটি বেঁজে উঠল। তখন তিনি ফোন রিসিভ করেন এবং তাকে বলা হলো আইজি সাহেবকে জানাতে রাষ্ট্রপতি কথা বলবে। তথাপি আইজি সাহেব কথা বললেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ফোন রেখে আমাদের দিকে চেয়ে আইজি সাহেব বললেন, রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিয়েছে কালো উর্দি পড়া ঘাতকের দল জেলের ভিতরে ঢুকবে। তাদেরকে যেন সহায়তা করা হয়। অত:পর আমরা জেল কর্তৃপক্ষ মেইনগেটি খুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের জেল হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত? কী করেছিল ঘটনার আগে ও পরে? কিভাবে সংগঠিত হলো এই নির্মম হত্যাকান্ড? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুবেদার ও সহবন্দিদের ভাষ্য নিয়ে চোখ ভিজে আসা, হৃদয়কে নাড়া দেয় সেই সব মর্মস্পশী বিবরন তৈরী করেছেন তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি। প্রধান জেল সুবেদারের ভাষ্য ছিল এ রকম:-
জেল সীমাদার মধ্যেই আমার বাসস্থান ছিল। সম্ভবত রাত আড়াইটার সময় পাগলা ঘন্টার আওয়াজ শুনে আমি দৌড়ে জেলে গেটে চলে আসি। গেটে এসে দেখি আর্মির লোক এসে গেছে। আইজি, ডিইআইজি সবার সামনেই জেলার সাহেব আমার হাতে একটা কাগজ তুলে দিলেন। বললেন এদের সবাইকে একসঙ্গে করুন। আমি দেখলাম কাগজটাতে ছয় জনের নাম। শেষ দুটো নাম ছিল তোফায়েল এবং রাজ্জাক সাহেবের। আমি সঙ্গে সঙ্গেই বললাম এই দুইজন লোক তো আমাদের জেলে নেই। তখন আবার এই দুটো নাম কেটে তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের নাম লেখা কাগজ দিয়ে জেলার সাহেব এই চারজনকে ভিতরে এক সঙ্গে করতে বললেন। আমি ভিতরে গিয়ে এরিয়া জামাদারকে নির্দেশ দিলাম চারজনকে একত্রিত করার জন্য। ইতি মধ্যে আমাদের অফিসাররাও ভিতরে চলে এসেছেন। ১নং রুমে তালা খোলার সময় তাজউদ্দিন সাহেব জিজ্ঞেস কররেন, কী ব্যাপার ? আমি বললাম আর্মি এসেছে। লিষ্টের নামের দুইজন ছিলেন ১নং রুমে, বাকী দুইজন ছিলেন ২নং ও ৩নং রুমে। বাকী দুইরুম খোলার সময় আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার ? আমি তো কিছুই জানি না। বললাম, বোধহয় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হবে। তাই আপনাদের নিয়ে যাবে। ১নং রুমে ৪জনকে এক সঙ্গে করবার পর তাজউদ্দিন সাহেব তাঁর তিন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সময় নেই, ওযু করে আসেন।’ চারজনই বাধরুমে থেকে ওযু করে এলেন। সৈয়দ সাহেবের চৌকিতে সবাই বসলেন। এর মধ্যে ঘাতক চারজন ঢুকলো। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সামনাসামনিভাবে গুলি করলো। প্রায় ৬০ রাউন্ড গুলির শব্দ। গুলি করার পর মুনসুর আলী সাহেব পানি-পানি বলে শব্দ করতেছিলেন। তখন আবার দ্বিতীয় দফায় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সকলের পেটে বেনেট চার্জ করা হয়। আমরা বাঙালি জাতি এই বর্বরোচিত কালিমা থেকে মুক্তি চাই।

‘নি:শ্বেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই তার, ক্ষয় নাই ॥

 

 

 

শাফায়েত জামিল রাজীব
-সম্পাদক
একুশে টাইমস

Print Friendly, PDF & Email

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © 2021
Design By Rana